ভারতবর্ষের জাতীয় পতাকার বিবর্তনের ইতিহাস || ভারতের জাতীয় পতাকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
প্রিয় বন্ধুরা,
আজকে ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। যার মাধ্যমে তোমরা ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য বা বর্ণনা, জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নিয়ম প্রভৃতি বিষয়গুলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা গঠন করতে পারবে। তাই দেরী না করে পোস্টটি ভালো করে দেখে নাও।
♦ ভারতীয় জাতীয় পতাকার আকার-
ভারতের জাতীয় পতাকাটি আয়তাকার এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ৩ : ২। অর্থাৎ লম্বা হবে ২ ফুট এবং আড়ে হবে ৩ ফুট। এর সাথে তিনটি রঙের আয়তক্ষেত্রের আয়তনের অনুপাত সমান রাখতে হবে।
♦ ভারতীয় জাতীয় পতাকার রঙ -
ভারতীয় জাতীয় পতাকায় গেরুয়া, সাদা, সবুজ ও নীল – এই চারটি রং ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতে জাতীয় পতাকাটির উপরে থাকে গেরুয়া, মাঝখানে সাদা এবং নীচে থাকে গাঢ় সবুজ রং সমানুপাতে। পতাকাটির মাঝখানে গাঢ় নীল রঙের চক্র রয়েছে। ভারতের জাতীয় পতাকার এই চারটি রঙ বিভিন্ন অর্থ বহন করে। যেমন-
১. ওপরে গাঢ় গৈরিক বা গেরুয়া বর্ণ- ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাহসিকতার প্রতীক ।
২. মাঝে সাদা রং- শান্তি, পবিত্রতা ও সত্যের প্রতীক ।
৩. নীচের সবুজ রং- জীবনধর্ম, নির্ভীকতা্, বিশ্বাস ও প্রাণ প্রাচুর্যের ইঙ্গিত বহন করে ।
৪. নীল রঙের চব্বিশটি দণ্ডযুক্ত “অশোকচক্র” – ন্যায়, ধর্ম, উন্নতি ও প্রগতির প্রতীক
♦ ভারতীয় পতাকার মাঝে অবস্থিত অশোক চক্র -
আশোক চক্রটি মহারাজ আশোকের রাজধানীতে সারনাথের সিংহমূতির আদলে নির্মিত।এই স্তম্ভের মধ্যে ২৪ টি দন্ড আছে।এই দন্ডগুলি দিনের ২৪ ঘন্টার প্রতীক। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বীরত্ব, সাহসী পদক্ষেপ বা আত্মাহুতির জন্য দেওয়া ভারতের সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ সামরিক পুরুষ্কারটিকেও বলা হয় অশোকচক্র। ভারতীয় জাতীয় পতাকায় অবস্থিত অশোক চক্রের ২৪টি দাগের অর্থ ২৪ রকমের। নিচের চিত্রের মাধ্যমে ২৪ টি অর্থ দেখানো হল।
♦ ভারতীয় জাতীয় পতাকা ব্যবহার নীতি -
ভারতীয় মানক ব্যুরো দ্বারা স্থির করে দেওয়া ভারতীয় পতাকাবিধি বা Indian flag code হল ভারতের জাতীয় পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেঁধে দেওয়া নিয়ম। পতাকা উৎপাদনের পদ্ধতি ও নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন এই পতাকাবিধির মধ্যে রয়েছে।
‘প্রিভেনশন অব ইনসাল্টস টু ন্যাশনাল অনার অ্যাক্ট ১৯৭১ অ্যান্ড ফ্ল্যাগ কোড অব ইন্ডিয়া’র কথা ভারতীয় আইনে বলা আছে। জাতীয় পতাকার রং, তার মাপ, ফ্ল্যাগ পোলের উচ্চতা— এ সব নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে সেখানে। ২০০২ সালে এই ফ্ল্যাগ কোড ‘প্রভিশন্স অব এমব্লেম অ্যান্ড নেমস (প্রিভেনশন অব ইনপ্রপার ইউজ) অ্যাক্ট ১৯৫০ অ্যান্ড প্রিভেনশন অব ইনসাল্টস টু ন্যাশনাল অনার (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০০৫’-এর সঙ্গে জুড়ে যায়। ভারতীয় জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নির্দিষ্ট কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। যেমন-
১. মুক্ত আকাশের তলায় সূর্যোদয়ের সময় পতাকা উত্তোলিত হয় এবং সূর্যাস্তের সময় নামিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারী ভবনে রাতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলনের রীতি আছে।
২. নতুন পতাকাবিধি অনুযায়ী মর্যাদা, গৌরব ও সম্মান অক্ষুন্ন রেখে যে কোনো নাগরিক বছরের যে কোনো দিনেই জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবে।
৩. জাতীয় পতাকার স্থান থাকবে অন্যান্য পতাকার থেকে সবার ওপরে
৪. গেরুয়া রং উপরের দিকে রাখতে হবে।
৫. ছিঁড়ে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত পতাকা তোলা যাবে না।
৬. টেবিলক্লথ হিসাবে বা কোনো প্লেটফর্মের সামনে আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না
৭. জাতীয় পতাকা কখনো মাটি বা জলকে স্পর্শ করবে না
৮. জাতীয় পতাকায় কোনো মূর্তি, নামলিপি বা শিলান্যাস প্রস্তর আটকানো যাবে না
৯. ২০০৫ সালের ৫ জুলাই সরকার পতাকাবিধি সংশোধন করে বস্ত্র বা ইউনিফর্ম হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করে।
১০. অন্তর্বাস হিসাবে, গাড়ির কভার রুমাল উত্তোলনের আগে ফুলের পাপরির বাইরে অন্য কোনো বস্তু তাতে বাঁধা বা পতাকাটিতে কোনো কিছু লেখাও নিষিদ্ধ।
১১. কোনো মিছিলে জাতীয় পতাকা ব্যবহার করলে, তা সকলের সামনে হাকবে কিন্তু কখনই তা অনুভুমিক ভাবে হাকবে না।
১২. কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির নির্দেশিকা অনুসারে শোকের চিহ্ন হিসাবে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার রীতি আছে; রাষ্ট্রপতি সেইক্ষেত্রে শোককালীন সময়সীমাও নির্ধারিত করে দেন। অর্ধনমিত করার আগে পতাকাটি একবার সম্পূর্ণভাবে উত্তোলিত করা হয়।
১৩. জাতীয় পতাকা ক্ষতিগ্রস্থ হলে বা অপরিস্কার হলে, একে ফেলে দেওয়া বা অমর্যাদায় নষ্ট করা যায় না।
১৪. সভাকক্ষে বক্তার কাছে প্রদর্শিত করতে হলে জাতীয় পতাকাকে বক্তার ডানদিকে রাখতে হয়। অন্য সময়ে পতাকাকে শ্রোতার ডানদিকে রাখতে হয়।
■ জাতীয় পতাকাঃ
কোন দেশ বা জাতির ঐতিহ্য, মর্যাদা ও গৌরবমণ্ডিত প্রতীককে জাতীয় পতাকা বলে।
■ ভারতের জাতীয় পতাকার ইতিহাসঃ
১৯০৬ সালের ৭ই আগস্ট কলকাতার পার্শি বাগানে ভারতের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল। পতাকাটি সবুজ, হলুদ ও লাল রঙের তিনটি অনুভূমিক ক্ষেত্র দ্বারা গঠিত ছিল। উপরের সবুজ অংশে আটটি সাদা পদ্ম আঁকা ছিল, হলুদ অংশে দেবনাগরী ভাষায় নীল রঙ দিয়ে বন্দেমাতরম্ লেখা ছিল এবং লাল অংশের একদিকে সাদা রঙের সূর্য ও অন্যদিকে অর্ধচন্দ্র আঁকা ছিল। নিম্নে পতাকাটির ছবি দেওয়া হল -
ভারতের জাতীয় পতাকা (১৯০৬) |
১৯০৭ সালে প্যারিসে ভিকাজি রুস্তম কামা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের পতাকা উত্তলন করেন। আগের পতাকার থেকে এই পতাকায় কিছুটা তফাৎ দেখা যায়। এই পতাকাটি ছিল গেরুয়া, সাদা ও সবুজ রঙের। উপরের গেরুয়া অংশে আটটি সাদা ফুল আঁকা ছিল, হলুদ অংশে দেবনাগরী ভাষায় কালো রঙ দিয়ে বন্দেমাতরম্ লেখা ছিল এবং সবুজ অংশের একদিকে সাদা রঙের সূর্য ও অন্যদিকে অর্ধচন্দ্র আঁকা ছিল। নিম্নে পতাকাটির ছবি দেওয়া হল -
ভারতের জাতীয় পতাকা (১৯০৭) |
১৯১৭ সালে হোমরুল লিগের নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য এক নতুন পতাকা উত্তলন করেন। নিম্নে পতাকাটির ছবি দেওয়া হল -
ভারতের জাতীয় পতাকা (১৯১৭) |
১৯২১ সালে বিজয়ওয়াড়ার জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে উত্তোলিত হয় ভারতের নতুন এক জাতীয় পতাকা। যেটি গান্ধিজিকে উপহার দেন অন্ধ্রপ্রদেশের এক ব্যক্তি। এই পতাকাটি ছিল সাদা, সবুজ ও লাল রঙের। নিম্নে পতাকাটির ছবি দেওয়া হল -
ভারতের জাতীয় পতাকা (১৯২১) |
১৯৩১ সালে এই পতাকা আবার পরিবর্তন করা হয়। বর্তমান পতাকার মতোই তাতে গেরুয়া, সাদা ও সবুজ রঙ ছিল। আর মাঝের সাদা অংশে মধ্যে ছিল চরকা। নিম্নে পতাকাটির ছবি দেওয়া হল -
ভারতের জাতীয় পতাকা (১৯৩১) |
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন যখন ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করলেন ১৫ই আগস্টে ভারত স্বাধীন হবে, গণপরিষদ তখন একটা অস্থায়ী কমিটি তৈরি করলেন স্বাধীন ভারতের পতাকা তৈরি করার জন্যে।
১৯৪৭ সালের ২২শে জুলাই ভারতের গণপরিষদে জাতীয় পতাকার নকশা গৃহীত হয়। এই জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি করেন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত্রিতে এই পতাকা জাতির উদ্দেশ্যে গণপরিষদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নিম্নে পতাকাটির ছবি দেওয়া হল -
ভারতের জাতীয় পতাকা (১৯৪৭) |
■ ভারতের জাতীয় পতাকার বর্ণনাঃ
ভারতের জাতীয় পতাকার তিনটি রঙ, তাই নাম ত্রিরঙা। পতাকাটি আয়তক্ষেত্রবিশিষ্ট এবং পতাকার দৈর্ঘ্য ৩ মিটার ও প্রস্থ ২ মিটার। পতাকাটি তিনটি আয়তক্ষেত্রবিশিষ্ট প্রথক তিনটি বর্ণের অংশ নিয়ে গঠিত অর্থাৎ তিনটি রঙেরই জমিন সমান। সবার ওপরে গেরুয়া, মাঝে সাদা ও নীচে গাঢ় সবুজ। পতাকাটির সাদা রঙের মাঝখানে একটি নল রঙের ২৪টি কাঁটাবিশিষ্ট চক্র বসান থাকে। এই চক্রটি সম্রাট অশোকের ধর্মচক্রের অনুকরণ, একে তাই অশোকচক্র বলে।
প্রতিটি রঙ এবং অশোকচক্র বিশেষ দার্শনিক অর্থ প্রকাশ করে। যেমন -
● গেরুয়া - শৌর্য, সেবা ও ত্যাগের প্রতীক।
● সাদা - শান্তি ও পবিত্রতার প্রতীক।
● গাঢ় সবুজ - কর্মশক্তি, নির্ভীকতা জীবনধর্মের প্রতীক।
● অশোকচক্র - দেশের উন্নতি ও প্রগতির প্রতীক।
■ জাতীয় পতাকা ব্যবহারের নিয়মঃ
● যেখানেই এই পতাকাটি উত্তোলিত করা হবে, সেখানেই যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে স্থাপন করতে হবে।
● পতাকার গেরুয়া রঙের দিক সবসময় উপরে থাকবে।
● কোন ব্যক্তি বা বস্তুর সামনে জাতীয় পতাকা নোয়ানো চলবে না।
● যদি এক লাইনে অন্য পতাকার সঙ্গে জাতীয় পতাকা ওঠানো হয়, তবে অন্য সব পতাকার থেকে জাতীয় পতাকা সবার উপরে থাকবে।
● সাধারণত জাতীয় পতাকা যেসব গুরুত্বপূর্ণ সরকারী ভবনে উড্ডীন রাখা হয় সেখানে জাতীয় শোকপ্রকাশ করতে কিংবা কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান দেখানোর সময় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
● ছেঁড়া, ফাটা কিংবা বিবর্ণ জাতীয় পতাকা উত্তোলন বেআইনি।
● জাতীয় পতাকা কুঞ্চিত অবস্থায় ব্যবহার করা যাবে না।
● জাতীয় পতাকার সঙ্গে অন্য কোন পতাকা একই দণ্ডে তোলা বা ব্যবহার করা যাবে না।
● জাতীয় পতাকা থেকে বেশি উচ্চতায় অন্য কোন পতাকা একসঙ্গে ব্যবহার করা যাবে না।
*** Flag Code of India 2022 অনুযায়ী, দিন ও রাত উভয় ক্ষেত্রেই পতাকা তুলে রাখা যাবে।
■ ভারতের জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তরঃ
প্রশ্নঃ ভারতের জাতীয় পতাকার দৈর্ঘ্য প্রস্থ কত ?
উত্তরঃ ভারতের পতাকার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ৩:২।
প্রশ্নঃ ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা কে করেন ?
উত্তরঃ পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া।
প্রশ্নঃ ভারতের জাতীয় পতাকা কবে গৃহীত হয় ?
উত্তরঃ ১৯৪৭ সালের ২২শে জুলাই।
প্রশ্নঃ আইন অনুযায়ী ভারতের জাতীয় পতাকা কোন কাপড়ে তৈরি হয় ?
উত্তরঃ খাদি কাপড়ে।
প্রশ্নঃ ভারতীয় জাতীয় পতাকার নকশা কোন পতাকা থেকে গ্রহণ করা হয় ?
উত্তরঃ পতাকাটির নকশা প্রস্তুত করা হয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া কৃত ‘স্বরাজ’ পতাকার আদলে।
প্রশ্নঃ ভারতের জাতীয় পতাকার ছবি কবে প্রথম ডাকটিকিটে স্থান পেয়েছিল ?
উত্তরঃ ১৯৪৭ সালের ২২শে নভেম্বর।
■ তথ্য সংগ্রহঃ পশ্চিমবঙ্গ মধ্য শিক্ষা পর্ষদের ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য ও শারীরশিক্ষা বই
কৃতজ্ঞতা স্বীকার - Kolom.in, studentscaring.com
Gk Study Guide Rules মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url